fbpx
বাড়িজাতীয়গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান তলানিতে, নেই কর্তৃপক্ষের নজরদারি

গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান তলানিতে, নেই কর্তৃপক্ষের নজরদারি

* সড়ক আইন প্রয়োগে উদাসীনতা * নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ কর্তৃপক্ষের*

গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান একেবারেই তলানিতে। এ সংক্রান্ত সব নির্দেশনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কঠোরভাবে কার্যকর করতেও সংশ্লিষ্টরা উদাসীন। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার যাত্রীসেবার মান বাড়াতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নির্দেশনা দেয়ার হলেও সংশ্লিষ্টরা এর তোয়াক্কা করেন না।

বস্তুত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীসেবার মান সমুন্নত না রেখে সরকারি নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই যাচ্ছে। অপরদিকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা নির্দেশনা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। আইন ও নির্দেশ বাস্তবায়নে কঠোর হওয়া তো দূরের বিষয়, নজরদারি করতেও আগ্রহ নেই তাদের।

বিভিন্ন গণপরিবহন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, রাজধানীতে চলাচলরত গণপরিবহনে নিয়মকানুন ও যাত্রীসেবার নুন্যতম মানও নেই। কোনো গণপরিবহনই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। সড়কের লাইন ও লেন ব্যাবহারের বিষয়টি অনেক চালকই ভালোভাবে জানেন না বা মানেন না। বাস-ট্রাক থেকে রিকশাÑ সব শ্রেনীর চালকই কোনো সংকেত না দিয়ে মূহুর্তেই এক লেন থেকে অন্য লেনে চলে যায়। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই রাস্তায় চলাচল করে।

আরামদায়ক আসন স্থাপনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা থাকলেও কোনো গণপরিবহন সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। অধিকাংশ গাড়িতেই সরকার নির্ধারিত আসনের চেয়ে ১০ থেকে ১৫টি আসন বেশি রয়েছে। ফলে আসনগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। যাত্রীদের বসতে অসুবিধা হয়। উপরন্তু আসন খালি না থাকার পরেও অধিক যাত্রী তুলে দাঁড়ানো অবস্থায় গাদাগাদি করে পরিবহন করা হয়। মিনিবাসের পেছনের সিটে চারজন বসানোর নিয়ম থাকলেও পাঁচ থেকে ছয়জন করে বসানো হয়। চালকের বাম পাশে তিনজনের সিটে চার থেকে পাঁচজন করে বসানো হয়।

ইঞ্জিনের উপর কোনো আসন না থাকার সরকারি নির্দেশনাও কেউ মানছে না। গাড়ির সবচেয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ ইঞ্জিন কাভারের উপর সিট স্থাপন করে কমপক্ষে ৫ জনকে বসানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুদের অধিকমাত্রায় বহন করা হচ্ছে ইঞ্জিনকাভারে বসিয়ে। একইভাবে চালকের পেছনের টুলবক্সের উপরও কমপক্ষে তিনজন যাত্রী বসানো হয়। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সামনের দিকের নয়টি সংরক্ষিত আসন নির্ধারিত থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এখন তা অনেক গণপরিবহনেই দেখা যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই। গণপরিবহন ও সড়কে অনিয়ম দূর করতে বিআরটিএ বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। কিন্তু যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট ফিটনেসের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। বিআরটিএ থেকে দেয়া কাগজপত্র দেখে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেন। কিন্তু ফিটনেস সনদের বাইরে গাড়ির বডি ও আসন সংখ্যার পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখেন না। পুরাতন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় বাস চালানো, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত ও ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের পরও মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থা নেয় না।

করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছর থেকে কয়েক দফায় গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিলো। পরবর্তীতে চলাচলের অনুমতি দেয়ার আগে কিছু নির্দেশনা দিয়ে তা বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন বলা হয়, যাত্রী উঠানোর আগে যাত্রীর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়। দাঁড়ানো অবস্থায় কোনো যাত্রী বহন করা যাবে না। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন ‘আইন না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার’ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু এই হুঁশিয়ারির সপ্তাহ খানেকের পরই সব আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।

পরিবহনের লোকজন মন্ত্রীর হুঁশিয়ারির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মতো করেই সড়কে চলাচল করে। এখন গণপরিবহনে আসন সংখ্যা অনুযায়ী যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনাও মানা হয় না। ঢাকা সিটিতে চলাচলরত সব গণপরিবহনেই দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা হয়। অথচ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া নজির নেই।

গণপরিবহনের নিয়মিত যাত্রী সারোয়ার হোসেন জানান, তিনি প্রায় প্রতিদিন মিরপুর থেকে কাওরানবাজার, প্রেস ক্লাব এলাকায় যাতায়াত করেন। পুরাতন ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাসেই তাকে যাতায়াত করতে হয়। যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে বিতর্ক প্রতিদিনই দেখেন তিনি। তার ক্ষুব্ধ মন্তব্য, ‘বিশে^র সব দেশ যাত্রীসেবার দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশ দিন দিন পিছিয়েই পড়ছে। আসন সংখ্যার অধিক যাত্রী নিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে বাসগুলো চলাচল করছে, অথচ পুলিশ নির্বিকার। সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এই দিকে বিশেষ নজর দেয়া দরকার।’

এই বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, গাড়ি পরিদর্শন করেই ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়। কিন্তু মালিকরা পরে আসন সংখ্যা নিজেদের ইচ্ছেমতো বাড়ায়।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে মালিক সমিতি থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দূরপাল্লার পরিবহন কোম্পানিগুলো যাত্রীসেবার দিকে সব সময় খেয়াল রাখে। এ ব্যাপারে যাত্রীদের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু রাজধানীতে চলাচলরত সিটি সার্ভিসগুলোতে কিছু সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধান করে যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণেই পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরছে না। বাড়ছে না যাত্রীসেবার মান। কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া যাত্রীসেবার মান উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। দিন দিন ভাড়া বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় সেবা আগের চেয়েও খারাপ হচ্ছে। ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে যাত্রীসেবার উন্নয়ন ও দুর্ঘটনা কমবে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গণপরিবহনে যাত্রীদের অধিকার প্রতিনিয়তই ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই যাত্রীরা সেবা পাচ্ছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো মনিটরিং নেই। আবার যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কেউ আমাদের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন না। তখন আমাদেরও আর কিছুই করার থাকে না। সূত্রঃ ভোরের কাগজ।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments