ত্যা ও ডাকাতি মামলার আসামি, বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত ও অছাত্ররা নেতৃত্ব পেয়েছেন চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে। গত ৩১ জুলাই রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ঘোষিত কমিটিতে তাঁদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতির পদে দেখা গেছে। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে।
চবি ছাত্রলীগের কমিটি :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখার সভাপতি মো. রেজাউল হক রুবেল প্রায় ১৬ বছর আগে এবং সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু ১২ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনে পদ পেতে ‘নিয়মিত ছাত্রত্ব’ ও ‘বয়সসীমা’ দুটির কোনোটা না থাকলেও তাঁরা এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতৃত্বে।
সম্প্রতি চবির এক ছাত্রীকে নিপীড়ন ও মারধরের ঘটনায় নেতৃত্বদানকারী মোহাম্মদ আজিমসহ চারজনকে গত ২৩ জুলাই গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব-৭। আজিম চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেলের অন্যতম অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শুধু আজিম নন, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত এবং আরো একাধিক অভিযুক্ত (গ্রেপ্তারের বাইরে থাকা) কয়েকজনের সঙ্গেও রুবেলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসের শীর্ষ এ নেতার সঙ্গে বিভিন্ন অভিযুক্তের অন্তরঙ্গ ছবি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
যবিপ্রবি ছাত্রলীগের কমিটি :
আগামী এক বছরের জন্য যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ছাত্রলীগের ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।এতে সোহেল রানাকে সভাপতি ও তানভীর ফয়সালকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।
কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার প্রায় আড়াই বছর পর শাখা ছাত্রলীগের এই কমিটি দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে চারজন সহসভাপতি হলেন আফিকুর রহমান অয়ন, নাজমুস সাকিব, মেহেদী হাসান ও আল মামুন সিমন। তিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন কামরুল হাসান শিহাব, এস এম ইকরামুল কবির দ্বীপ ও নূর মোহাম্মদ টনি। দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন মনিরুল ইসলাম হৃদয় ও মুরাদ পারভেজ। এঁদের মধ্যে তানভীর হত্যা ও ডাকাতি এবং সিমন ডাকাতি মামলার আসামি।
বিশ্ববিদ্যালয় ও পদবঞ্চিত নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিরোধের জেরে ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাঈমুল ইসলামকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নাঈমুলের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলে প্রথমে থানা পুলিশ এবং পরে সিআইডি মামলাটির তদন্ত করে। মামলার তদন্ত শেষে ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। আসামির তালিকায় ৩ নম্বরে রয়েছে তানভীর ফয়সালের নাম। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ মসিয়ূর রহমান আবাসিক হলে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসানের নেতৃত্বে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তখন শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩০০টি মুঠোফোন সেট, ১০০টি ল্যাপটপ ও অর্থ নিয়ে যায় ডাকাতরা। ঘটনার তিন দিন পর ৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস ২৫ জনের নামে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় ১১ নম্বর আসামি করা হয় তানভীর ফয়সালকে। আর ১০ নম্বর আসামি করা হয় আল মামুন সিমনকে।
ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা ও মাদক বিক্রেতার তালিকায় নাম রয়েছে কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া এস এম ইকরামুল কবিরের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে সাময়িক বহিষ্কারও করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পাঁচ বছর ধরে রয়েছেন তানভীর ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘হত্যা ও ডাকাতি মামলায় বর্তমানে জামিনে রয়েছি। তা ছাড়া আমি এখনো আদালতে দোষী প্রমাণিত হইনি। এসব মামলায় রাজনৈতিকভাবেই আমার নাম জড়ানো হয়েছে। ’
ইবি ছাত্রলীগ :
গত ৩১ জুলাই রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে আইন বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতকে সভাপতি এবং অর্থনীতি বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের নাসিম আহমেদ জয়কে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
জানা যায়, নতুন কমিটির সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত আগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সহসম্পাদক থাকাকালীন ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ তাঁর কর্মী শাহজালাল সোহাগের (দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ) বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাকক্ষের জানালার কাচ ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ মার্চ আরাফাতকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে দলীয়ভাবে তদন্ত করে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়।
ফয়সালের বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ চলাকালে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ক্যাম্পাসের লেকে মাদক সেবন ও ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে আটক দুই কর্মীকে পুলিশের গাড়ি থেকে কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রার্থনাকক্ষে ভাঙচুরের ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কে বা কারা ভাঙচুর করে আমাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ফাঁসিয়েছে। দলীয় তদন্তে পরবর্তী সময়ে এটা প্রমাণ পেয়ে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। ’
পুলিশের গাড়ি থেকে আটক কর্মীদের কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে ফয়সাল বলেন, ‘এ ঘটনায়ও আমি জড়িত ছিলাম না। যারা জড়িত ছিল, পরে তাদের সাজা হয়েছে। আমার জড়িত না থাকার বিষয়ে থানার ওসি প্রত্যয়নপত্রও দিয়েছেন। ’
বেরোবি ছাত্রলীগ :
আগের কমিটি বিলুপ্তির ৯ মাস পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শাখা ছাত্রলীগের ৩০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এতে পোমেল বড়ুয়াকে সভাপতি এবং মাহফুজুর রহমান শামীমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। কমিটি অনুমোদনের পর থেকেই নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
জানা যায়, নতুন ঘোষিত সভাপতি ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। এরই মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটিরই ফল পেয়েছেন তিনি। সাধারণ সম্পাদক একই শিক্ষাবর্ষের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রত্ব না থাকলে সংগঠনে থাকতে পারবেন না। তবে কেন ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও কমিটির সর্বোচ্চ পদ পেলেন এই দুই নেতা, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান নেতারা।
নতুন সভাপতি পোমেল বড়ুয়া বলেন, ‘কমিটি বিলুপ্তির দিন থেকে আমাদের ছাত্রত্ব ও বয়সসীমা হিসাব করা হয়। কমিটি বিলুপ্তির দিন থেকে শুরু করে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করার কয়েক মাস পর গত ২১ মার্চ ২০২২ আমাদের মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে আমার একটি বিষয়ে ইমপ্রুভমেন্ট ছিল। জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ কর্মসূচির দিন আমি যথোপযুক্ত কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আমরা এমবিএতে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছি। অনেকেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিয়ে বিভিন্নভাবে ভুয়া তথ্য দিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। ’
কমিটিগুলোর ব্যাপারে মন্তব্য জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন দিলেও তাঁরা ধরেননি।